বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৩

ভাঙা গড়া


( পৃথিবীটা বড্ড বদলে যাচ্ছে, বদলাতেই আছে দিনকে দিন।আমরা চোখের সামনে শুধু বদলে যাওয়া পৃথিবীটা দেখছি। সত্যি বলতে কি আমরা এই রদবদলের বাইরে নই। সমাজের মূল্যবোধের সংজ্ঞা বদলে গিয়ে বিকৃত হচ্ছে। আজকে যেটাকে আমরা ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে বিশ্বাস করছি, কিছুকাল আগেও সেটা ছিল ঘোর অন্যায়। খুব সাবলিলভাবে বদলে যাওয়া পৃথিবীটাতে আমরা আসলে কতটুকু মানুষ বলে নিজেকে পরিচয় দেবার যোগ্যতা অর্জন করছি ? সেটা একটা বড় প্রশ্ন )

টেকনোলজি এর জয়জয়কার এর এই যুগে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলো খুব বেশি দ্রুত গতিতে আমাদের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে। মানুষের জীবনদর্শনও পরিবর্তন হচ্ছে সমান তালে। ইদানিং গ্রামে গঞ্জে আর কিছু না পৌঁছালেও স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো ঠিক পৌছে যাচ্ছে। ঘরে ঘরে টিভির পর্দায় মনমুগ্ধকর চোখা ধাধানো দৃশ্যের প্রতি মানুষের আকর্ষন ঠেসে যাচ্ছে। রঙিন পর্দায় জ্বল জ্বল করতে থাকা নায়িকার মেকাপ গেটাপ দেখে দেখে মানুষের রুচি প্রকৃতিও বদলাচ্ছে খুব সাবলিলভাবেই।

নায়ক নায়িকার পোশাক চলন বলন হয়ে উঠছে সাধারন মানুষের জন্য আদর্শ। তিশা কিংবা জয়ারা স্টার হয়ে উঠার পাশাপাশি এদের অনুসরণ করার মানুষদের সংখ্যাও বেরেই চলেছে। ভাল মন্দ ভাবার টাইম নাই, স্টাইল এ থাকা চাই। এই নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে গড়ে উঠছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এফ এম র্যা ডিগুলোতে রাত জেগে জেগে গানের জগতে ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের। কল এর মাধ্যমে বয়ফ্রেন্ড এর কাছে শুভেচ্ছা পৌঁছানোর জন্য জকিরাও বেশ উচ্ছসিত। ভালবাসার সংজ্ঞাটা দিনকে দিন বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড এর অবৈধ সম্পর্কের মধ্যে বন্দী হয়ে গোঙাতে শুরু করেছে।হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকার নামে নামে ঈদের বাজারে পোশাক বিক্রি হচ্ছে। সাথে সাথে সেই নায়িকারাও হয়ে উঠছে অনুকরণীয়।প্রেমিকের কাছে প্রেমের প্রস্তাব, কিভাবে পুরুষের আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে হয় সেটা শিখে নেয়া এখন খুব সহজ। সেই সাথে ধর্ষনের শিকার মেয়েদের সংখ্যাটাও বাড়ছে।

রঙিন পর্দার প্রেম ভালবাসার অদ্ভুত প্রকাশভঙ্গী দেখে দেখে ছেলেমেয়রা নিজেদের স্বপ্নময়তা কিংবা জাফর স্যার এর ভাবালুতায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। আসলে কোন জীবনদর্শনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজ, আমাদের প্রজন্ম ? এসবের মাঝে মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার উপকরণগুলো কোথায় ? স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির সংখ্যা তো বাড়েছেই, কিন্তু মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা কোথায় পাচ্ছে সন্তানেরা ? টিভির পর্দায় টম ক্রুজ এর একশন তো দেখছে, কিন্তু জীবনে ভাল এবং সুন্দর দিকগুলোকে শিখে নিয়ে খারাপ আর অসত্যের বিরুদ্ধে একশানে যেতে শিখছে কি ছেলেমেয়েরা ?টম আর জেরির খুনসুটিতো দেখছেই, কিন্তু সত্য মিথ্যার তফাত করতে শিখছে তো শিশুরা ?
আসলে আমাদের জীবনপাঠশালায় শিক্ষকের অভাব এখন চরমে। সবাই শিখছি টেলিভিশন এর রঙিন পর্দা থেকে। যেখানে ভাল কিছু শেখার সুযোগটা ক্ষীণ। যারা এই রঙিন পর্দাগুলোর নেপথ্যে কলকাঠি নাড়াচ্ছেন সবাই জুব হয়ে আছেন অর্থ উপার্জনের নেশায়, আর একটা খুব গভীর ষড়যন্ত্রের জাল রচনায় সব প্রচেষ্টা ঢেলে দিচ্ছে একটা দল।

গানবাজনা, নাটক সিনেমায় মজে যাওয়া মন মস্তিষ্কগুলো ভোতা হয়ে যাচ্ছে। নিজের মধ্যে মানুষের গুন বৈশিষ্টগুলো তরতাজা করে তোলার যে সময়টা সেটা অপচয় হচ্ছে অবহেলায়। কিছু রিয়্যালিটি শো এর মাধ্যমে অনেক বাবা মা এখন সন্তানদের স্টার বানাবার স্বপ্ন দেখছেন। সন্তানকে স্কুলের পাশাপাশি নাচগানের চর্চা করাচ্ছেন অনেক অনেক অভিভাবক। কিন্তু মানুষের প্রকৃত গুনাগুনের চর্চা করাচ্ছেন কয়জন অভিভাবক ?

এইসব সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আমাদের সমাজকে কি মানুষের মত মানুষ উপহার দিচ্ছে ? নাকি মানুষের ভেতরের মানুষটাকে মেরে ফেলে এক একটা অমানুষ বানাচ্ছে সেটা গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়। এ পর্যন্ত আমি শুধু আমার দেশের সাংস্কৃতিক পরিবির্তনের কথা লিখছিলাম। আমাদের দেশে গত ২ দশকে আকাশ সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের প্রভাব এর ফসল আজকের বাংলাদেশ। এখনকার সাংস্কৃতিক এই বিরাট পরিবর্তন আরো সামনে গিয়ে কোন পর্যায়ে দাঁড়াতে পারে তার একটা অনুমান করা যায়।
পাশ্চাত্যে এই পরিবর্তনটা অনেক আগেই হয়ে গেছে। পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিক বিপর্যয় যখন চূড়ান্ত তখন ঠিক সেই মুহুর্তে একি রকম বিপর্যয়ের সূচনা হয়েছে মাত্র আমাদের সমাজে।

পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের একটা স্পষ্ট চিত্র আমারা দেখেছি, দেখছি। সেই বিপর্যয়টা উপলব্ধি করতে পেরেছেন পাশ্চাত্যেরই অনেক সাহিত্যিক, দার্শনিক। কিন্তু এ থেকে উত্তরনের পথটা অনেক বেশি কঠিন। পশ্চিমা সমাজে মানুষের মধ্যে অস্তিত্ব সঙ্কটের মূলে রয়েছে মানুষের বিশ্বাসের বিভ্রান্তি। এবং বিশ্বাসের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে খুব সুক্ষভা্বে। মানুষের মনে ভোগ, আনন্দ, ফুর্তির স্পৃহা গেঁড়ে দিয়ে, সেখান থেকে বিশ্বাসের ভিতগুলোকে উপড়ে ফেলা হয়েছে ধীরে ধীরে। ফলে মানুষ অর্থ, আনন্দ ফুর্তি, নারী, এসবের গোলাম হতে পেরেছে, কিন্তু সত্যিকার আত্মিক প্রশান্তি থেকে নিজেদের সহস্র মাইল দূরে ঠেলে দিয়েছে। নারী স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের নাম করে কর্পোরেট জগতটা নারীদের ব্যবহার করে সমাজের ভাঙ্গন ঘটিয়েছে।ইংরেজিতে existential crisis যেটাকে বলা হয়ে থাকে, তার পরিনতি খুব বেশি ভয়ানক। এখন আমরা দেখি পাশ্চাত্যে পরিবার প্রথা ভেঙ্গে গেছে, এখানে সমর্কের পবিত্রতার কোন বালাই নেই। ইচ্ছা করলেই যে কেউ যে কারো সাথে যা ইচ্ছা করতে পারে। পত্রিকায় আমরা খবর পেয়েছি কিভাবে আপন বাবা মেয়েকে ধর্ষন করতে পারে। আমেরিকায় প্রতি মিনিটে কয়জন করে ধর্ষনের শিকার হয় সেটা নিয়ে জরিপের শেষ নেই। এই পশ্চিমারাই পৃথিবীর আনাচে কানাচে গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, মিলিটারি ইনভেশনের মাধ্যমে অন্যদেশের মানুষদের নির্বিচারে মারছে। এদের অর্থনৈতিক উম্ময়নের উদাহরণ আমরা সব সময়ই দিয়ে থাকি, কিন্তু এদের ভেঙ্গে খানখান হয়ে যাওয়া সমাজের মানুষগুলো আসলে কতটুকু মানুষের পরিচয় বহন করে সেটা ভেবে দেখার বিষয়।

আমাদের সমাজও ঠিক সেদিকেই আগাচ্ছে। সূচনালগ্ন পেরিয়ে আমাদের সমাজ খুব দ্রত গতিতেই পাশ্চাত্যের পরিনতির দিকেই আগাচ্ছে। সেলিব্রেটি কালচার ইতিমধ্যেই অবস্থান করে নিয়েছে। সেলিব্রেটিদের অনুসরন করার অভ্যাস আমাদের ভেতর মনের অজান্তেই জায়গা করে নিচ্ছে। টেলিভিশনের রঙিন পর্দার মানুষগুলো আসলে কতটুকু অনুসরনীয় ? । তাদের জীবনযাত্রা মানুষের মনের পর্দায় যে দুলুনির সৃষ্টি করে চলেছে সেটা থেকে আমাদের রেহাই নেই। তাদের দেখেই মানুষ নিজের অজান্তেই স্বপ্নের দেশে ঘুরে বেরাবে, ভাবালুতায় ডুব দেবে, সম্পর্কগুলোকে নাটকের মত করে সাজাতে চাইবে। বাস্তবতা আর ধর্মীয় বিশ্বাসের মত কঠিন, ভাবগাম্ভির্যপূর্ন বিষয়গুলোকে এড়িয়ে চলতে শিখবে, আত্মিক, চারিত্রিক উন্নয়ন ভুলে গিয়ে ভোগ আর বস্তুবাদী চিন্তা চেতনার ট্যাবলেট খেয়ে মানুষের আসল পরিচয় ভুলে যাবে। তালাকের সংখ্যা ভিশন রকম বেড়েই চলেছে ইদানিং। সাথে সাথে লিভটুগ্যাদারের মত ঘটনা সেলিব্রেটিদের অনেকেই করছেন ইতিমধ্যেই। কিছুদিন আগে ইমনের ঘটনা আমরা জেনেছি, সে তার গার্লফেন্ড প্রইবর্তনের সাথে সাথে লিভটুগ্যাদার এর রেকর্ড করতে যাচ্ছিল। এরাই আবার টিভির পর্দায় হাস্যজ্জ্বল মুখ নিয়ে প্রেম বিরহের ফিরিস্তি গাইবে।

নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং স্বাধীনতার নামে তাদেরকে নোংরামিতে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, আর নারীরা দলে দলে এই ধ্বংস লীলায় অংশ নিতে ছুটছে। সুন্দরী প্রতিযগিতার মাধ্যমে চ্যানেল আই এর মত ধ্বংসবাজরা যৌনকর্মী পয়দা করছে, নারীদের ভোগের সামগ্রী বানাচ্ছে অথচ এর পরিনতি কতটা ভয়ানক আমরা এখনো উপলব্ধি করতে পারছিনা কেন ? এক সময় এই নারীরাই তাদের মান মর্যাদা পাশ্চাত্যের নারীদের মতই একটা ভয়ানক অন্ধকার জগতে বিলিন করে দেবে। ভোগের পন্যে পরিনত হয়ে আমাদের সমাজের মেয়েরাও ভুলে যাবে তাদের প্রকৃত মর্যাদা। পোশাকে আশাকে নেংকটামিকেই ওরা স্বাধীনতা বলে মনে প্রানে বিশ্বাস করতে শিখবে, ঠিক এখন যেমনটা ভাবছে পশ্চিমা নারীরা।

খারাপগুলো শুধু মেনে নিতে নিতে সবাই এক সময় খারাপগুলোকে খারাপ বলতেও ভুলে যাবো।বলতে শিখবো এসবতো ব্যাক্তি স্বাধীনতার বিষয়। এভাবেই আমাদের সমাজ পাশ্চাত্যের পরিনতির দিকে ঝুঁকে যেতে যেতে এক সময় হয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষেরা Existential Crisis এ ভুগতে শুরু করবে। মানুষ শান্তির জন্য হন্যে হয়ে হাতরাতে থাকবে অথচ বুঝে উঠতে পারবেনা কিসে তাদের শান্তি। পাশ্চাত্যের মানুষেরা যেভাবে প্রকৃত ইসলাম চর্চায় শান্তির পরশ খুঁজে পাচ্ছে, সেভাবে হয়তো আবার আমাদের সমাজের মানুষেরাও শান্তির জন্য পুনরায় ইসলামের সান্ন্যিদ্ধ পেতে দিকে দিকে ছুটে আসবে।
কিন্তু ভাংগা গড়ার এই খেলায় কিছু মানুষ কাজ করে যাবে শুধু প্রশান্তি প্রতিষ্টার জন্য। সেই দলের মানুষেরা মানুষের সঠিক পরিচয় দেবার মত সুযোগ্য হয়েই নিজেদের গড়ে নেবে শত বাধা উপেক্ষা করে ......

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন